Skip to main content

 https://www.channelionline.com/devisuktas-soothsayer-woman-ambhrini/

দেবীসূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা নারী অম্ভৃণি

শাস্ত্রে বলে, ঋষিরা মন্ত্র বানিয়ে লিখতেন না, তারা সেটি দেখতে পেতেন। দেবীদুর্গার পূজায় পাঠ করা হয় যে সূক্ত, তার মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি ছিলেন একজন নারী। এতে দেখা যাচ্ছে যে, নারীরাও মন্ত্রদর্শনের অধিকারী ছিলেন।

ঋকবেদের অম্ভৃণির সূক্তই বেদের ‘দেবীসূক্ত’ নামে খ্যাত, চণ্ডিপাঠে এই সূক্ত পড়তে হয়। যদিও বেদে দেবী দুর্গার কোনো বর্ণনা নেই। তবু অনেকে ঋকবেদের দেবীসূক্তকে দুর্গার সূক্ত বলেই মনে করেন। তবে মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী ভাগবতের মতো প্রাচীন পুরানে আমরা দুর্গার বিবরণ পাই। পুরান মতে, দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, আদিশক্তি মহামায়া তথা শিবের স্ত্রী পার্বতীর চণ্ডি বা উগ্ররূপ এবং শাক্তদের পূজিত।

Bkash July

বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় লেখা প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋকবেদ। এটি বেদের চারখণ্ডের প্রথম। গবেষকরা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ থেকে ১১০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়কে ঋগ্বেদ রচনার সময়কাল হিসেবে ধরেন। সনাতন ধর্মের আদি উৎস বেদে দেবতাদের গুণগান ও তাদের নিয়ে স্তোত্র বা শ্লোক, সূক্ত তথা মন্ত্র রচনার পাশাপাশি দেবী শক্তি, মহিমা বা শক্তি-উপাসনার প্রাচীন নজির হিসেবে যে সূক্তের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেটি দেবীসূক্ত। সে হিসেবে এটি দেবীশক্তির মহিমার প্রাচীনতম নিদর্শনও বটে। তবে আরও গুরুত্বের বিষয় যে, এই ঋক বা মন্ত্রের রচনাকারীও একজন নারী ঋষি। এবার তার কথা বলি।

আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার বছর আগের প্রাচীন ভারত। সেখানে জন্মেছিলেন আত্মজ্ঞানপিপাসু এক নারী। নাম তার বাক্। বাক অর্থ বাণী। মহর্ষি অম্ভৃণের কন্যা তিনি, তাই আরেক নাম অম্ভৃণি। অম্ভৃণি বা বাক দেবীসূক্ত রচনা করেছেন বলে একে অম্ভৃণিসূক্ত বা বাকসূক্ত-ও বলা হয়। সূক্ত শব্দের অর্থ হলো, যা সু বা শোভন ভাবে বলা হয়।

Reneta June

‘অহম্ রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।’ অম্ভৃণ ঋষির মেয়ে বাক বা অম্ভৃণি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের এ ১২৫তম সূক্তে জানাচ্ছেন, ‘আমি একাদশ রুদ্র, অষ্ট বসু, দ্বাদশ আদিত্য এবং বিশ্বদেবতারূপে বিচরণ করি।’ এই সূক্তে ব্রহ্মশক্তি, রুদ্র, আদিত্য ও ইন্দ্র, অগ্নি, অশ্বিনী কুমারসহ বিশ্ব দেবতার সঙ্গে ব্রহ্মবিদুষী বাক নিজ অভিন্নতা ঘোষণা করেছেন!

দেবীসূক্তে মোট আটটি শ্লোক বা মন্ত্র আছে। প্রথম এবং তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্লোক ত্রিষ্টুপ ছন্দে রচিত এবং দ্বিতীয় শ্লোক জগতী ছন্দে রচিত। মন্ত্রগুলোকে একত্রে বৈদিক দেবীসূক্তম বলে। সাধারণভাবে চণ্ডিপাঠের পূর্বে ঋগ্বেদের রাত্রিসূক্ত এবং পাঠান্তে দেবীসূক্ত পাঠ করা হয়।

‘অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসুনাম চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম।

বিজ্ঞাপন

তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্য্যাবেশয়ন্তীম্।

আমি জগতের ঈশ্বরী, ধনপ্রদায়িনী। ব্রহ্মকে জ্ঞাতা আমার আমিই যাঁদের জন্য যজ্ঞ করা হয় তাদের মধ্যে প্রথমা।

বহুরূপে সর্বভূতে প্রবিষ্টা সেই আমাকে বহুস্থানে বা সর্বদেশে আরাধনা করা হয়।’

( ঋগ্বেদ: দশম মণ্ডল, দশম অনুবাক, ১২৫তম সূক্ত, মন্ত্র ৩)

দেবীসূক্ত নিয়ে বেদের সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রাচীন ভাষ্যকার বা টীকাকার সায়ণাচার্য্য বলেছেন, অম্ভৃণ কন্যা বাক পরমাত্মার সাথে নিজের অভিন্নতা উপলব্ধি করে জগৎরূপে নিজেকে ব্রহ্ম উপলব্ধি করেছেন, যা ‘স্বাত্মানম অস্তৎ’। আবার ব্রহ্মরূপিণী ভগবতী এখানে ব্রহ্মবিদুষী বাককে যন্ত্ররূপে গ্রহণ করে তার ভিতর দিয়েই নিজের জগৎব্যাপী আত্মস্বরূপের পরিচয় দিয়েছেন।

বেদ সূত্রে বলা যায়, ব্রহ্মবাদিনী বাক অনুভব করেছিলেন সবই ব্রহ্মের অংশ এবং তিনি নিজের মধ্যে সমস্ত দেবতা, চরাচর বা বিশ্বকে ধারণ করে আছেন। এটি সরাসরিভাবে দেবীমহিমা নয়। কিন্তু নারী বা দেবীত্বের এই অনুভবকে কেন্দ্র করেই পরবর্তিতে শক্তিতত্ত্বের বিকাশ ঘটেছে।

বাক্-সূক্ত তাই প্রকৃতপক্ষে দেবীকেই ইঙ্গিত করে। কারণ বাকসূক্তে বাক যা বলেছেন তা স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দে এবং নিজেকে আদ্যাশক্তি দেবীর স্বরূপে বিবরণ দিয়ে স্তোত্র আকারে। বাক নিজেকে এই শক্তির সঙ্গে একাত্ম করেছেন। অদ্বৈতবাদ অনুসারে যে ব্রহ্মকে জ্ঞাত হয় তাকেই ব্রহ্ম স্বরূপ বলা হয়। বাক এই স্তোত্র রচনার মাধ্যমে আদ্যাশক্তি দেবীর স্বরূপ নিজের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই তিনি ব্রহ্মস্বরূপা। তাই এটি দেবীসূক্ত।

দেবী সূক্তে নির্দিষ্ট করে কোন নাম বা উপাধি বিশিষ্ট দেবীর কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ এখানে আদ্যাশক্তিকে নির্দিষ্ট কোন রূপেই সীমাবদ্ধ করা হয়নি। এটি দেবীর বিশ্বময় স্বরূপের প্রকাশ। এ সূক্তটি বেদোত্তর সাহিত্যেই বস্তুত দেবী-সূক্ত নামে অভিহিত হয়েছে। কারও কারও মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যে দেবীশক্তি নিহিত রয়েছে,  এই উপলব্ধি থেকেই পরে এই শক্তি নানা নামে শাক্তপূজার প্রধান উপাস্য দেবতায় পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে, মার্কন্ডেয় পুরানের দেবী মাহাত্ম্যে নারায়ণী স্তুতি শুরুর একটি শ্লোকে বলা হচ্ছে, ‘স্ত্রীঃ সমস্ত সকলা জগৎসু’ অর্থাৎ, প্রত্যেক স্ত্রী বা নারীর মধ্যেই জগৎ তথা দেবীসত্ত্বা বিরাজমান। অম্ভৃণি বা বাকও সেই আদ্যাশক্তি দেবীর স্বরূপে নিজেকে ব্রহ্মের সাথে একাত্ম করেছেন। জগতের সকল নারীরই সে অধিকার আছে, যেন ঘোষণা করেছেন সে কথাই।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Comments

Popular posts from this blog

টগবগ টগবগ ছুটছে শুধু…

ঘোড়ার খুরের আওয়াজ জনসন রোড হয়ে সদরঘাট যাওয়ার পথে কান পাতলে এখনো ভেসে আসে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। মধ্য দুপুরের কড়া রোদে চাবুক মেরে ঘোড়া ছুটিয়ে সওয়ারি নিয়ে যাচ্ছেন ব্যস্ত কোচোয়ান। এ পথেই ঘোড়ার গাড়িতে বুড়িগঙ্গার ধারে নিজের মহলে ফিরতেন ঢাকার নবাব,সে শত বছর আগে । আজ নবাব নেই , কিন্তু রয়ে গেছে তার নবাবী বাহন। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক আজ এই ঘোড়ার গাড়ি। এই ঘোড়ায় টানা গাড়ির ইতিহাস ১৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। তবে ঢাকাবাসীর কাছে আজও ফুরায়নি এর কদর। সাধারণের মুখে যার নাম - টমটম। গুলিস্তান টু সদরঘাট শহরের প্রতিদিনের ঘৌড়দৌড়ের জীবনে যন্ত্রচালিত গাড়ির ভীড়। তবু ঢাকার একাংশে এখনো কোনরকমে জায়গা করে আছে ঘোড়াগাড়ি। বাস - ট্রাক , মোটর সাইকেলের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘোড়ার পা  টিকে থাকার তাগিদে দৌড়াচ্ছে। গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার থেকে সদরঘাট। নিয়মিত এই রুটে যাত্রী পরিবহন করছে তারা। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চলছে জীবনের ঘোড়দৌড়। একটি ঘোড়ার গাড়ি সাধারণত ১০ জন করে যাত্রী বয়। ভাড়া জনপ্রতি ২০ টাকা। মাঝে মধ্যে শখের বশে ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করেন ঈসমাইল হোসেন । বল্লেন , বাস...
  ভক্তি আন্দোলন ও নারীত্বের তকমা অতিক্রম করার গল্প এক: ভক্তি আন্দোলন সমাজ, ধর্ম আর রাজনীতির বাধাবিপত্তিকে ছাড়িয়ে ভারত জুড়ে এক অভূতপূর্ব মানবতার বার্তা ছড়িয়ে একটি অভূতপূর্ব আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছিল। ভক্তিবাদীরা প্রচার করেন, সমস্ত ধর্মই সমান। প্রথা সর্বস্ব আচার অনুষ্ঠানের পরিবর্তে জীবে প্রেম ও ঈশ্বরের প্রতি অখণ্ড ভক্তি ও সমর্পণই মুক্তির পথ। তারা বিশ্বাস করতেন, মানুষের মর্যাদা নির্ভর করে তার কাজে, জন্মের ওপর নয়। ভক্তিবাদে ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তির মিলন হয় প্রেমের দোহাইয়ে। এই আন্দোলন মধ্যযুগে এনে দিয়েছিল স্বস্তির দমকা হাওয়া যা এই উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল আর এই ভক্তি সুর-মাধুর্যে মানুষের মধ্যে দিয়েছিল এক মুক্তির বার্তা। জনমানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল মুক্তির গান। কি সামাজিক ভাবে, কি ধর্মীয়ভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন নারীরাও। ভক্তি আন্দোলনে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ শুধু সমাজ-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বেড়াজাল ভাঙার ক্ষেত্রেই নয়, নারী-পুরুষের সামাজিক- লৈঙ্গিক বৈষম্য ভাঙতেও ভূমিকা রেখেছে। উপরন্তু সেই আন্দোলনে বেশকিছু দিক বদলকারী প্রভাব রেখেছিলেন নারীরাই। পর্যবেক্ষকরা নানা কা...

নাটালি ডিয়াজ: কী হয় যদি আমি ‘পোস্টকলোনিয়াল’য়ের মত শব্দের পাশে ‘ভালবাসা’র মত একটা শব্দ বসাই? - Rottenviews

নাটালি ডিয়াজ: কী হয় যদি আমি ‘পোস্টকলোনিয়াল’য়ের মত শব্দের পাশে ‘ভালবাসা’র মত একটা শব্দ বসাই? - Rottenviews : নাটালি ডিয়াজ: কী হয় যদি আমি ‘পোস্টকলোনিয়াল’য়ের মত শব্দের পাশে ‘ভালবাসা’র মত একটা শব্দ বসাই? Shameema Binte Rahman Interview December 3, 2021 আদিবাসী, ক‍্যুয়ার, এবং কবি নাটালি ডিয়াজ। ক‍্যাটাগরীক‍্যাল এই তিন আইডেন্টিটির বাইরে আরো অনেক পরিচয়ে তাকে পরিচিত করা হয় বা তিনি পরিচিত হন, কিন্তু ডিয়াজ এই সকল ‘পিন-আপ’ পরিচয় ছাটাই করে ‘আনপিনাবল’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াও জারি রেখেছেন। কবিতা, কবিতার ভাষা, ভাষার খেলা, পরিচিত হওয়ার পরিচয়ের খোপ, খাপ বদলানোর ফাঁদ, প্রেম, উপনিবেশকারী আর উপনিবেশের অধীনস্তের সম্পর্কের মারপ‍্যাঁচ দুলে দুলে নেচে নেচে ছড়ায়ে ভেসে ওঠে তার শব্দে, কবিতায়। এই বছর তিনি পুলিৎজার পান, পোস্টকলোনিয়াল লাভ পয়েম (২০২০)/ Postcolonial Love Poem বইয়ের জন‍্য। এটা তার দ্বিতীয় কবিতার বই, প্রথম বই হোয়েন মাই ব্রাদার ওয়াজ অ‍্যান এজটেক (২০১২)/ When My Brother Was an Aztec। অ‍্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তিনি ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিষয়ে পড়াচ্ছেন। স্কুল জীবনে বাস্কেটবল খেলতে খেলতে তিনি প্রফেশনাল ...