Skip to main content

টগবগ টগবগ ছুটছে শুধু…



ঘোড়ার খুরের আওয়াজ
জনসন রোড হয়ে সদরঘাট যাওয়ার পথে কান পাতলে এখনো ভেসে আসে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। মধ্য দুপুরের কড়া রোদে চাবুক মেরে ঘোড়া ছুটিয়ে সওয়ারি নিয়ে যাচ্ছেন ব্যস্ত কোচোয়ান।
এ পথেই ঘোড়ার গাড়িতে বুড়িগঙ্গার ধারে নিজের মহলে ফিরতেন ঢাকার নবাব,সে শত বছর আগে । আজ নবাব নেই, কিন্তু রয়ে গেছে তার নবাবী বাহন।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক আজ এই ঘোড়ার গাড়ি। এই ঘোড়ায় টানা গাড়ির ইতিহাস ১৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। তবে ঢাকাবাসীর কাছে আজও ফুরায়নি এর কদর। সাধারণের মুখে যার নাম -টমটম।

গুলিস্তান টু সদরঘাট
শহরের প্রতিদিনের ঘৌড়দৌড়ের জীবনে যন্ত্রচালিত গাড়ির ভীড়। তবু ঢাকার একাংশে এখনো কোনরকমে জায়গা করে আছে ঘোড়াগাড়ি। বাস-ট্রাক, মোটর সাইকেলের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘোড়ার পা  টিকে থাকার তাগিদে দৌড়াচ্ছে।
গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার থেকে সদরঘাট। নিয়মিত এই রুটে যাত্রী পরিবহন করছে তারা। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চলছে জীবনের ঘোড়দৌড়।
একটি ঘোড়ার গাড়ি সাধারণত ১০ জন করে যাত্রী বয়। ভাড়া জনপ্রতি ২০ টাকা।
মাঝে মধ্যে শখের বশে ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করেন ঈসমাইল হোসেন। বল্লেন, বাসের ভীড়ের চেয়ে ঘোড়ার গাড়িতে আরামে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। এছাড়া যানজট থাকলে তখন বাস আর ঘোড়ার গাড়ির গতিতে খুব হেরফের হয় না বলেই তার মত।
২৭ বছর ধরে রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির সিরিয়াল দেখাশোনার কাজ করেন লাইনম্যান মোহাম্মদ টিপু সুলতান। তিনি জানালেন, এখন পুরান ঢাকার সদরঘাট, ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, বঙ্গবাজার, বকশীবাজার কেরানীগঞ্জ এলাকায় প্রায় ৪০টি ঘোড়ার গাড়ি যাত্রী বহনের কাজ করছে।

ঘোড়ার গাড়ি, বাহারি
হাতিশালে হাতি আর ঘোড়াশালে ঘোড়া না থাকলে রাজা-বাদশার বাদশাহী জেল্লাই বৃথা। সেই স্বপ্নের রেশটুকু আজও রয়ে গেছে মানুষের মনে। উৎসব, অনুষ্ঠানে একদিনের বাদশা হয়ে উঠতে বাধা কি!
তাই যাত্রী পরিবহন বাদেও বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠানে ঘোড়ার গাড়ির চাহিদা অনেক। বিশেষ করে পুরান ঢাকার বিয়েতে `পংখীরাজ ঘোড়ায় চেপে` রাজার কুমার সেজে বিয়ে করতে না গেলে যেন বিয়ের আনন্দই মাটি। ঘোড়ার গাড়িকে তাই বরযাত্রার বাহন হিসেবে ব্যবহারের চল রয়েছে এখানে।
এসব কাজে ঘোড়ার গাড়িকে ফুল,জরি-চুমকি, রঙিন কাগজ নানান রঙের ফিতা, বেলুন দিয়ে সাজানো হয়। এই সময় কোচোয়ান তার সহযোগীর জন্যও থাকে বিশেষ পোশাক।

এছাড়াও অন্যান্য উৎসব ও আয়োজনে `রিজার্ভ` ভাড়া দেয়া হয় ঘোড়ার গাড়ি। শুক্রবার ছুটির বিকেলে সাজসজ্জা করা ঘোড়ার গাড়িতে চেপে স্বপরিবারে বেড়াতে বের হওয়া পুরান ঢাকাইয়াদের শাহবাগের রাস্তায় দেখা যায় হরহামেশা।
ঈদ, পূজা, সুন্নতে খাৎনা, বিভিন্ন দিবসের শোভাযাত্রা, নাটক- সিনেমার শুটিং তো আছেই, বাদ যায় না রাজনৈতিক দলের মিছিলও।
গাড়ির আগে ঘোড়া জুড়ে যে ঘোড়ার জুড়ি-গাড়ি, তাতে প্রতিটি গাড়িতে দুটি করে ঘোড়া লাগে। লোহা বা স্টিল দিয়ে গাড়ির কাঠামো তৈরি হয়। তার সঙ্গে চাকা লাগিয়ে প্রস্তুত হয় গাড়িগুলো।
ঘোড়ার গাড়ির মালিক পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দা মোঃ রিপন শিকদার জানালেন, একটি ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করতে দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে একটি ঘোড়া কিনতেই ৩০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত লেগে যায়।

ঘোড়া ছোটানোর দিন
বংশ পরম্পরায় ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ানের কাজ করে যাচ্ছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা আব্দুল বারেক। জানালেন, প্রতিদিন সদরঘাট থেকে গুলিস্তান রুটে গাড়ি নিয়ে ১০ থেকে ১২ বার যাওয়া -আসা করেন তিনি। তবে যানজটে ট্রিপের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যে টাকা দিন শেষে পান, তাতে ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে ভাল্ভাবে বসবাস করা কঠিন। তবু ঘোড়া ছোটানো যেন রক্তের নেশা। এখনো আকড়ে আছেন তাই বাপ-দাদার এই পেশাই।
ঘোড়ার মালিক মোঃ রিপন শিকদার জানালেন, দৈনিক ২ হাজার টাকার মত ভাড়া ওঠে। এরমধ্যে কোচোয়ান দৈনিক ৫শ ও তার সহযোগি ২শ করে পায়।
বললেন, আগের তুলনায় ঘোড়ার খরচ বেড়েছে। দিনে তিন বার ঘোড়াগুলিকে খাওয়াতে হয়। দিনে প্রায় ২০ কেজি গমের ভুসি, ছোলার ভুসি, ঘাস লাগে। এতেও খরচ যায় ৬-৮শ টাকার মত ।
নিয়মিত নয়, অসুস্থ হয়ে পড়লে ঘোড়াগুলোকে চিকিৎসার জন্য পশু হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি।
ঢাকার রাস্তায় গাড়ী টানছে যে ঘোড়াগুলি তাদের স্বাস্থ্য অনেকটাই রুগ্ন। তাদের শ্রমে মালিকের ঘরে পয়সা-কড়ি আসলেও ঘোড়ার কপালে জোটে `ঘোড়ার ডিম`। কোন কোনটার শরীর হাড় জিরজিরে। পুষ্টির অভাব প্রকট এই অসহায় প্রানীটিই যে শৌর্যের প্রতীক কে দেখে বলবে তা! প্রয়োজন মত পুষ্টিকর খাবার ও বিশ্রামের অভাব, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন এবং চিকিৎসা ও যত্ন না পেয়ে অশ্বশক্তি নিঃশেষ তাদের।

ইতিহাসের পথ ধরে 
যে তিনটি উপাদান বাড়িয়ে দিয়েছিল পৃথিবীর সভ্যতার গতি তা হল- চাকা, ঘোড়া আর লোহা।
৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ মানুষ ঘোড়াকে ঘরে পোষা শুরু করে। সংস্কৃত ঘোটক থেকে বাংলায় ঘোড়া শব্দটি এসেছে। ঘোড়া বা ঘোটক দ্রুতগামী চতুষ্পদ জন্তু যার পিঠে চড়া যায়। দ্রুতগামী বলে এর অন্য নাম তুরগ, তুরঙ্গম।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ১৮৫৬ সালে প্রথম ঢাকা শহরে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ঘটে, যা তখন 'ঠিকা গাড়ি' নামে পরিচিত ছিল।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের 'ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী-' বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ১৮ শতকের প্রথম দিকে ঢাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে আর্মেনীয়রা ছিলো অন্যতম প্রভাবশালী বণিক সম্প্রদায়। ১৮৫৬ সালে সিরকো নামীয় একজন আর্মেনীয়ই প্রথম ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন করেন।
১৮৪৪ সালে প্রকাশিত 'ক্যালকাটা রিভিউতে' নানা ধরনের ঘোড়ার গাড়ির উল্লেখ রয়েছে; যাতে ঢাকায় চলাচলকারী গাড়িগুলোকে 'ক্রাহাঞ্চি' বা 'ক্রাঞ্চি' গাড়ি ('কারাচি গাড়ি') বলা হয়েছে।
প্রথমদিকে শুধু রাজা-বাদশাহ,জমিদারদের মত অভিজাত শ্রেণী ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করত। সাধারণ মানুষের কাছে ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত ছিল তখন গরীবের ঘোড়ারোগের সামিল।
ইতিহাসের দিন গড়ায়। পরে একসময় সাধারণ মানুষের নাগালে চলে আসে ঘোড়ার গাড়ি।
ঐতিহ্যের এই বিশেষ বাহনটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার এগিয়ে না এলে দ্রুতই তা বিলুপ্তির পথে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

মিথলজির ঘোড়া
শক্তি ও গতির প্রতীক ঘোড়া শুধু মানুষের নয়, দেবতাদেরও প্রিয়। হিন্দু পুরানে, সূর্যদেবতা সাত ঘোড়ায় টানা রথে চড়ে বের হতেন আকাশ পরিভ্রমণে। পুরাণ মতে, সাতটি স্বর্গীয় ঘোড়ার নাম উষ্ণিক, বৃহতী, জগতী, ত্রিষ্টুভ, অনুষ্টুভ, পংক্তি গায়ত্রী। আর সমূদ্র মন্থনে দেবরাজ ইন্দ্র লাভ করেছিলেন উচ্চৈশ্রবা নামের রাজঅশ্ব।
মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে চারটি ঘোড়ায় টানা রথ নিয়ে অর্জুনের সারথী ছিলেন ভগবান শ্রী কৃষ্ণ।
এদিকে গ্রীক পুরাণেও ঘোড়ার ছড়াছড়ি। গ্রীকদেবতাদের রয়েছে পক্ষিরাজ ঘোড়া পেগাসাস। সাদা রঙের এই ঘোড়ার রয়েছে দুটি উড়ে যাবার ডানা । আর জাদুকরী বা শান্তি বিস্তারকারী এক শিঙ্গওলা ঘোড়া ইউনিকর্ন উপকথার পাতা থেকে উঁকি দেয় এখনো।

দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের 'বুসিফেলাস', মহাবীর রুস্তমের 'রাখস', চেঙ্গিস খানের 'নাইমান', হযরত আলীর (রাঃ) 'দুলদুল' আর রানা প্রতাপ সিংহের 'চেতক বা চৈতক'- নামের ঘোড়াগুলি ইতিহাসের পাতায় ধুলো উড়িয়ে ছুটছে আজও।



Comments

Popular posts from this blog

  ভক্তি আন্দোলন ও নারীত্বের তকমা অতিক্রম করার গল্প এক: ভক্তি আন্দোলন সমাজ, ধর্ম আর রাজনীতির বাধাবিপত্তিকে ছাড়িয়ে ভারত জুড়ে এক অভূতপূর্ব মানবতার বার্তা ছড়িয়ে একটি অভূতপূর্ব আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছিল। ভক্তিবাদীরা প্রচার করেন, সমস্ত ধর্মই সমান। প্রথা সর্বস্ব আচার অনুষ্ঠানের পরিবর্তে জীবে প্রেম ও ঈশ্বরের প্রতি অখণ্ড ভক্তি ও সমর্পণই মুক্তির পথ। তারা বিশ্বাস করতেন, মানুষের মর্যাদা নির্ভর করে তার কাজে, জন্মের ওপর নয়। ভক্তিবাদে ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তির মিলন হয় প্রেমের দোহাইয়ে। এই আন্দোলন মধ্যযুগে এনে দিয়েছিল স্বস্তির দমকা হাওয়া যা এই উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল আর এই ভক্তি সুর-মাধুর্যে মানুষের মধ্যে দিয়েছিল এক মুক্তির বার্তা। জনমানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল মুক্তির গান। কি সামাজিক ভাবে, কি ধর্মীয়ভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন নারীরাও। ভক্তি আন্দোলনে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ শুধু সমাজ-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বেড়াজাল ভাঙার ক্ষেত্রেই নয়, নারী-পুরুষের সামাজিক- লৈঙ্গিক বৈষম্য ভাঙতেও ভূমিকা রেখেছে। উপরন্তু সেই আন্দোলনে বেশকিছু দিক বদলকারী প্রভাব রেখেছিলেন নারীরাই। পর্যবেক্ষকরা নানা কা...

নাটালি ডিয়াজ: কী হয় যদি আমি ‘পোস্টকলোনিয়াল’য়ের মত শব্দের পাশে ‘ভালবাসা’র মত একটা শব্দ বসাই? - Rottenviews

নাটালি ডিয়াজ: কী হয় যদি আমি ‘পোস্টকলোনিয়াল’য়ের মত শব্দের পাশে ‘ভালবাসা’র মত একটা শব্দ বসাই? - Rottenviews : নাটালি ডিয়াজ: কী হয় যদি আমি ‘পোস্টকলোনিয়াল’য়ের মত শব্দের পাশে ‘ভালবাসা’র মত একটা শব্দ বসাই? Shameema Binte Rahman Interview December 3, 2021 আদিবাসী, ক‍্যুয়ার, এবং কবি নাটালি ডিয়াজ। ক‍্যাটাগরীক‍্যাল এই তিন আইডেন্টিটির বাইরে আরো অনেক পরিচয়ে তাকে পরিচিত করা হয় বা তিনি পরিচিত হন, কিন্তু ডিয়াজ এই সকল ‘পিন-আপ’ পরিচয় ছাটাই করে ‘আনপিনাবল’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াও জারি রেখেছেন। কবিতা, কবিতার ভাষা, ভাষার খেলা, পরিচিত হওয়ার পরিচয়ের খোপ, খাপ বদলানোর ফাঁদ, প্রেম, উপনিবেশকারী আর উপনিবেশের অধীনস্তের সম্পর্কের মারপ‍্যাঁচ দুলে দুলে নেচে নেচে ছড়ায়ে ভেসে ওঠে তার শব্দে, কবিতায়। এই বছর তিনি পুলিৎজার পান, পোস্টকলোনিয়াল লাভ পয়েম (২০২০)/ Postcolonial Love Poem বইয়ের জন‍্য। এটা তার দ্বিতীয় কবিতার বই, প্রথম বই হোয়েন মাই ব্রাদার ওয়াজ অ‍্যান এজটেক (২০১২)/ When My Brother Was an Aztec। অ‍্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তিনি ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিষয়ে পড়াচ্ছেন। স্কুল জীবনে বাস্কেটবল খেলতে খেলতে তিনি প্রফেশনাল ...