Skip to main content

 https://www.dhakatimes24.com/2022/07/12/269416ঐশ্বরিক প্রেমের সাধক রাবেয়া বসরি

পারস্যের মরমি সাধক রাবেয়া বসরি একবার হজে যাচ্ছিলেন। পথে মরুভূমিতে তার গাধা গেল মরে। সঙ্গী-সাথিরা তাকে সাহায্য করতে চাইলেন। সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মৃত গাধার পাশেই বসে থাকলেন তিনি। আর দুহাত তুলে অঝোর কান্নায় প্রশ্ন তুললেন তার প্রভুর কাছে, ‘হে আল্লাহ, তুমি কি চাও, নাকি চাও না যে আমি তোমার ঘরে যাই?’ তখনই মরা গাধা উঠল লাফিয়ে, নিজের পায়ে গেল দাঁড়িয়ে! আর রাবেয়া আবার যাত্রা শুরু করলেন মক্কার পথে।

ইরানের প্রখ্যাত সুফি কবি ফরিদউদ্দীন আত্তারের (১১৪৫-১২২১) সাধক ও সুফিদের জীবনী নিয়ে বই ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া’তে রাবেয়ার ঐশ্বরিক ভালোবাসার কাহিনি এভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়, আল্লাহর প্রতি রাবেয়ার আনুগত্য ও বিশ্বাস ছিল সীমাহীন। তার অশ্রু ও তার অধিকারবোধ ছিল সমুদ্রসমান। কেননা, আল্লাহর প্রতি তার ভালোবাসারও কোনো সীমা মাপা ছিল না। রাবেয়া বসরির প্রার্থনা-কবিতায় তাই উঠে আসে এসব শব্দ:

যদি দোজখের ভয়ে নেই নাম তোমার

জাহান্নামের আগুন তবে আমাকে পোড়াক।

যদি বেহেশতের লোভে গাই নাম তোমার

জান্নাতের দরজা তবে বন্ধ হয়ে যাক।

যদি ডাকি তোমায় তোমারই প্রেমে

তবে নিও না মুখ সরিয়ে আড়ালে!

গোলাপ ফুলের জন্য বিখ্যাত ইরাকের বসরা নগরী। অষ্টম শতকের বসরায় আধ্যাত্মিকতার সবচেয়ে সুগন্ধি গোলাপ হয়ে যেন জন্মেছিলেন সাধক ও কবি রাবি ‘আ আল আদাবিয়্যা (৭১৭-৮০১), যিনি রাবেয়া বসরি নামেই অধিক পরিচিত। দরিদ্র ও ধার্মিক বাবা-মার চতুর্থ সন্তান হিসেবে জন্ম নেন তিনি, রাবেয়া শব্দের অর্থও চতুর্থ। বাবা-মা মারা গেলে শৈশবেই, দুর্ভিক্ষের সময় তাকে ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। নিষ্ঠুর মনিবের জন্য সকাল থেকে রাত অবধি বিরামহীন কাজ করে যেতে হতো তাকে। কিন্তু রাতে তিনি ইবাদত চালিয়ে যেতেন। সব বিপদ-আপদকে তিনি আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবেই নিতেন। গভীর চিন্তা ও ধ্যানমগ্ন রাবেয়া দাসজীবনে শত কাজের মধ্যেই রোজা রাখতেন ও প্রার্থনা চালিয়ে যেতেন। বছরের পর বছর যায় এভাবেই।

আকাশে জ্বলছে তারা

আর নিদ্রামগ্ন মানুষেরা,

রাজারা বন্ধ করেছে দুয়ার

আর প্রতিটি প্রেমিক

তার প্রিয়ার সঙ্গে একা।

হে আল্লাহ,

শুধু আমি, এখন এখানে

একা তোমার সঙ্গে।

এর মধ্যেই একদিন ঘটল এক অলৌকিক ঘটনা। ফরিদউদ্দীন আত্তারের বর্ণনায়, রাবেয়ার মনিব একরাতে প্রার্থনারত রাবেয়ার মাথার ওপর দেখলেন জ্যোতির্ময় বলয়। বিস্মিত হয়ে তিনি ভাবলেন, এ তো কোনো সাধারণ নারী হতে পারে না। রাবেয়াকে সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত করে দিলেন তিনি। মুক্তি পেয়ে প্রথমে মরুভূমির নির্জনে চলে যান রাবেয়া। ছোট্ট কুটির করে সেখানেই বাস শুরু করেন। বলা হয়, আল্লাহর স্মরণে তার দুটি চোখ থাকত সব সময়ই ভেজা। প্রতি রাতের মোনাজাতে রাবেয়ার শব্দে তাই উঠে আসত সেই আকুলতা:

হে আল্লাহ, আরেকটা রাত পার হয়ে যাচ্ছে

আসছে আরেক দিন...

বলো আমাকে, যে রাতটি পার হয়েছে ভালোভাবে,

এতে মিলবে আমার শান্তি,

আর যদি বলো, রাতটা নষ্ট করে ফেলেছি

তবে যা হারিয়েছি তার জন্য শোক তো করতে পারি।

শপথ করে বলছি, যেদিন তুমি ফিরিয়ে দিয়েছ এই জীবন

সেদিন থেকে তুমি বন্ধু হয়েছ আমার

সেদিন থেকে আর ঘুমাইনি কখনো রাতে।

এমনকি যদি তাড়িয়ে দাও তোমার দরজা থেকে

আবারও শপথ, আমরা আলাদা হবো না কোনোভাবে

কেননা তুমি বেঁচে আছ আমার হৃদয়ে মিশে।

সেকালের ধর্মীয় নেতাসহ অনেকেই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, তবে রাবেয়া বেছে নেন নির্জন তপস্বীর জীবন। সাধনার নিষ্ঠতায় তিনি হয়ে ওঠেন যুগশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক সাধক। তাজকেরাতুল আউলিয়ায় তার আরেকটি বর্ণনা আছে যে, জীবিকার জন্য একবার সুতা কেটে রাবেয়া দুটি মুদ্রা পেলেন। দুই হাতে দুটি মুদ্রা নিয়ে তিনি ভাবলেন, দুই থেকে চার হবে, চার থেকে আট, এভাবেই বহু। অথচ তিনি তো শুধু একের উপাসনা করেন! এক আল্লাহ ছাড়া তো তার অন্য চাওয়া নাই। এই ভেবে মুদ্রা দুটি তিনি পানিতে ছুড়ে ফেললেন। তার জীবন ছিল এ রকমই কঠোর তপস্যার ও পরজগৎমুখী। অতীন্দ্রিয়বাদী ও ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে একসময় তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দূরদূরান্তে। তিনি খ্যাত হন তাপসী রাবেয়া নামে।

আমি এক কড়া প্রহরী

যে আছে ভেতরে তাকে দিই না বেরোতে

বাইরে যা আছে তা-ও থাকুক বাইরে।

যদি দরজা খুলে দিই

আসবে যার খুশি, চলেও আবার যাবে

আমার সঙ্গে তার কী-বা বন্ধন আছে!

হৃদয়ের দরজায় দৃঢ় রক্ষক হয়ে রই, ভেজা মাটির কোনো দলা তো আমি নই।

অন্য অনেক মুসলিম সাধকের মতো রাবেয়ার প্রতিও অসংখ্য কারামাত বা অলৌকিকত্ব আরোপ করা হয়। অতিথি এলে বা তার নিজের অনাহারে ঐশী উপায়ে খাবার চলে আসত তার ঘরে। আবার অন্ধকারে তার বাতির অভাব পূরণ হতো আঙুলে জ্বলে ওঠা অলৌকিক আলো দিয়ে! আবার একদিনের ঘটনা এ রকম, ফোরাত নদীর তীরে রাবেয়া আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। সে সময়ের শ্রেষ্ঠতম সাধক হাসান বসরি সেখানে হাজির (যদিও হাসান বসরি ৭২৮ সালে যখন মারা যান, তখন রাবেয়ার বয়স মাত্র ১১ বছর। তবে ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া’য় হাসান বসরি ও রাবেয়া বসরিকে সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন কাহিনি বর্ণনা রয়েছে)। হাসান বসরি তার জায়নামাজ নদীর পানিতে বিছালেন, রাবেয়ার ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্যই যেন তিনি রাবেয়াকে আহ্বান জানালেন সেখানে নামাজ পড়ার। রাবেয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে তার জায়নামাজটি বাতাসে ভাসিয়ে দিলেন। বললেন, আপনি যা দেখালেন তা এমন কিছু নয়, সামান্য মাছও তা পারে, আর আমি যা দেখালাম তা তুচ্ছ মাছিও পারে। আসল কাজ কিন্তু এর অনেক ওপরে।

ঈশ্বরকে পেতে, ভয় বা লোভ নয়, ভালোবাসাই একমাত্র শর্ত হওয়া উচিতÑএই মতবাদ প্রচার করে গেছেন রাবেয়া। তার কবিতার পরতে পরতে সেই ভালোবাসার আকুলতাই দীপ্ত। বিখ্যাত সাধক ও ধর্মতত্ত্ববিদ ইবনুল জাওজি, ফরিদউদ্দীন আত্তার ও ইমাম গাজালি রাবেয়া বসরির ভাবধারা দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন।

এক হাতে মশাল আর

আরেক হাতে জলের পাত্র

এই নিয়ে আগুন ধরাতে যাই বেহেশতে

আর নিভাই আগুন দোযখের!

যাতে আল্লাহর পথের সব অভিযাত্রী

সমস্ত পর্দা ছিঁড়ে

সন্ধান পায় সঠিক পথের।

আধ্যাত্মিক জগতে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লেও জাগতিক জীবনের বিলাস উপকরণ থেকে কঠোরভাবে দূরে থাকতেন রাবেয়া। ইহলোকের সম্বল হিসেবে জীর্ণ কুটিরে একটি পানির পাত্র ও মাদুর ছাড়া কিছুই রাখতেন না। একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া দুনিয়াদারির সবকিছুই যে ছিল তার কাছে মূল্যহীন। হাজার বছর পার হয়ে ইসলামের আধ্যাত্মিক ধারায় সাধক রাবেয়ার নাম তাই চির ভাস্বর হয়ে আছে।

অবিচল বন্ধু আমার,

বারবার তুমি বিক্ষত করেছ আমাকে,

যখন কথা বলি আমি

আমার প্রতিটা শব্দ তোমার কথা বলে

যখন চুপ করে থাকি,

নীরবে তড়পাই তোমার জন্য।


Comments

Popular posts from this blog

টগবগ টগবগ ছুটছে শুধু…

ঘোড়ার খুরের আওয়াজ জনসন রোড হয়ে সদরঘাট যাওয়ার পথে কান পাতলে এখনো ভেসে আসে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। মধ্য দুপুরের কড়া রোদে চাবুক মেরে ঘোড়া ছুটিয়ে সওয়ারি নিয়ে যাচ্ছেন ব্যস্ত কোচোয়ান। এ পথেই ঘোড়ার গাড়িতে বুড়িগঙ্গার ধারে নিজের মহলে ফিরতেন ঢাকার নবাব,সে শত বছর আগে । আজ নবাব নেই , কিন্তু রয়ে গেছে তার নবাবী বাহন। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক আজ এই ঘোড়ার গাড়ি। এই ঘোড়ায় টানা গাড়ির ইতিহাস ১৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। তবে ঢাকাবাসীর কাছে আজও ফুরায়নি এর কদর। সাধারণের মুখে যার নাম - টমটম। গুলিস্তান টু সদরঘাট শহরের প্রতিদিনের ঘৌড়দৌড়ের জীবনে যন্ত্রচালিত গাড়ির ভীড়। তবু ঢাকার একাংশে এখনো কোনরকমে জায়গা করে আছে ঘোড়াগাড়ি। বাস - ট্রাক , মোটর সাইকেলের সাথে পাল্লা দিয়ে ঘোড়ার পা  টিকে থাকার তাগিদে দৌড়াচ্ছে। গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার থেকে সদরঘাট। নিয়মিত এই রুটে যাত্রী পরিবহন করছে তারা। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চলছে জীবনের ঘোড়দৌড়। একটি ঘোড়ার গাড়ি সাধারণত ১০ জন করে যাত্রী বয়। ভাড়া জনপ্রতি ২০ টাকা। মাঝে মধ্যে শখের বশে ঘোড়ার গাড়িতে যাতায়াত করেন ঈসমাইল হোসেন । বল্লেন , বাস...
  ভক্তি আন্দোলন ও নারীত্বের তকমা অতিক্রম করার গল্প এক: ভক্তি আন্দোলন সমাজ, ধর্ম আর রাজনীতির বাধাবিপত্তিকে ছাড়িয়ে ভারত জুড়ে এক অভূতপূর্ব মানবতার বার্তা ছড়িয়ে একটি অভূতপূর্ব আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছিল। ভক্তিবাদীরা প্রচার করেন, সমস্ত ধর্মই সমান। প্রথা সর্বস্ব আচার অনুষ্ঠানের পরিবর্তে জীবে প্রেম ও ঈশ্বরের প্রতি অখণ্ড ভক্তি ও সমর্পণই মুক্তির পথ। তারা বিশ্বাস করতেন, মানুষের মর্যাদা নির্ভর করে তার কাজে, জন্মের ওপর নয়। ভক্তিবাদে ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তির মিলন হয় প্রেমের দোহাইয়ে। এই আন্দোলন মধ্যযুগে এনে দিয়েছিল স্বস্তির দমকা হাওয়া যা এই উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল আর এই ভক্তি সুর-মাধুর্যে মানুষের মধ্যে দিয়েছিল এক মুক্তির বার্তা। জনমানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল মুক্তির গান। কি সামাজিক ভাবে, কি ধর্মীয়ভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন নারীরাও। ভক্তি আন্দোলনে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ শুধু সমাজ-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বেড়াজাল ভাঙার ক্ষেত্রেই নয়, নারী-পুরুষের সামাজিক- লৈঙ্গিক বৈষম্য ভাঙতেও ভূমিকা রেখেছে। উপরন্তু সেই আন্দোলনে বেশকিছু দিক বদলকারী প্রভাব রেখেছিলেন নারীরাই। পর্যবেক্ষকরা নানা কা...

নাটালি ডিয়াজ: কী হয় যদি আমি ‘পোস্টকলোনিয়াল’য়ের মত শব্দের পাশে ‘ভালবাসা’র মত একটা শব্দ বসাই? - Rottenviews

নাটালি ডিয়াজ: কী হয় যদি আমি ‘পোস্টকলোনিয়াল’য়ের মত শব্দের পাশে ‘ভালবাসা’র মত একটা শব্দ বসাই? - Rottenviews : নাটালি ডিয়াজ: কী হয় যদি আমি ‘পোস্টকলোনিয়াল’য়ের মত শব্দের পাশে ‘ভালবাসা’র মত একটা শব্দ বসাই? Shameema Binte Rahman Interview December 3, 2021 আদিবাসী, ক‍্যুয়ার, এবং কবি নাটালি ডিয়াজ। ক‍্যাটাগরীক‍্যাল এই তিন আইডেন্টিটির বাইরে আরো অনেক পরিচয়ে তাকে পরিচিত করা হয় বা তিনি পরিচিত হন, কিন্তু ডিয়াজ এই সকল ‘পিন-আপ’ পরিচয় ছাটাই করে ‘আনপিনাবল’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াও জারি রেখেছেন। কবিতা, কবিতার ভাষা, ভাষার খেলা, পরিচিত হওয়ার পরিচয়ের খোপ, খাপ বদলানোর ফাঁদ, প্রেম, উপনিবেশকারী আর উপনিবেশের অধীনস্তের সম্পর্কের মারপ‍্যাঁচ দুলে দুলে নেচে নেচে ছড়ায়ে ভেসে ওঠে তার শব্দে, কবিতায়। এই বছর তিনি পুলিৎজার পান, পোস্টকলোনিয়াল লাভ পয়েম (২০২০)/ Postcolonial Love Poem বইয়ের জন‍্য। এটা তার দ্বিতীয় কবিতার বই, প্রথম বই হোয়েন মাই ব্রাদার ওয়াজ অ‍্যান এজটেক (২০১২)/ When My Brother Was an Aztec। অ‍্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তিনি ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিষয়ে পড়াচ্ছেন। স্কুল জীবনে বাস্কেটবল খেলতে খেলতে তিনি প্রফেশনাল ...